JAFB | Journalist Alliance Foundation of Bangladesh
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

গ্রহাণুর আঘাতে ডাইনোসর মারা গেলেও অন্য প্রাণীরা বাঁচলো কিভাবে?

আজ থেকে ৬ কোটি ৬০ লক্ষ বছর আগে পৃথিবীতে আঘাত হেনেছিল একটি অ্যাস্টারয়েড বা গ্রহাণু – বা মহাকাশে ঘুরতে থাকা কোন ধ্বংসপ্রাপ্ত গ্রহের টুকরো। এতই প্রচণ্ড ছিল সেই আঘাত যে তার ফলে পৃথিবীর সব ডাইনোসর মারা গিয়েছিল। কিন্তু সেই ভয়ঙ্কর ঘটনায় এত বিশাল বিশাল ডাইনোসররা মারা গেলেও ছোট ছোট কিছু স্তন্যপায়ী প্রাণী কিন্তু মারা যায়নি। কিভাবে বেঁচে ছিল তারা?

একবার কল্পনা করে দেখা যাক পৃথিবীর বুকে গ্রহাণুর আঘাতের পর পরিবেশটা কেমন হয়েছিল।

আজকে যেখানে মেক্সিকো – তারই উপকুলে প্রচণ্ড গতিতে এসে আছড়ে পড়েছিল বিশাল আকারের সেই গ্রহাণুটি। সেটি ছিল ছয় মাইল বা ১০ কিলোমিটার চওড়া, এবং তা পৃথিবীকে আঘাত করেছিল ১০০ কোটি পারমাণবিক বোমার চেয়েও বেশি শক্তি নিয়ে।

বনজঙ্গলে আগুন লেগে গিয়েছিল, সাগরে সৃষ্টি হয়েছিল সুনামি। বাতাসে উৎক্ষিপ্ত হয়েছিল বাষ্প হয়ে যাওয়া শিলা, ছাই আর ধুলো উঠে গিয়েছিল পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে কয়েক মাইল উঁচু পর্যন্ত।

পৃথিবীর বুকে তৈরি হয়েছিল মারাত্মক তাপ, বাতাস ভরে গিয়েছিল ছাইয়ে, নেমে এসেছিল ঘোর অন্ধকার।

চারদিকে পড়ে ছিল ডাইনোসররা। কেউ ইতোমধ্যেই মৃত, কেউ মৃতপ্রায়।

তখন পর্যন্ত পৃথিবীর ইতিহাসে জীবিত প্রাণীদের জন্য সেটিই ছিল সবচেয়ে খারাপ দিন।

কিন্তু তার মধ্যেই দেখা গেল একটি ক্ষুদ্র প্রাণীকে। সে ওই নারকীয় ধ্বংসস্তুপের মধ্যেই খাদ্যের সন্ধানে নেমেছে – একটি দু’টি পোকা ধরে খাচ্ছে, আবার ছুটে গিয়ে তার গর্তে আশ্রয় নিচ্ছে।

পৃথিবীর ইতিহাসে এরকম মহাদুর্যোগ এসেছিল এর আগে আরেক বার – ২৫ কোটি ২০ লাখ বছর আগে, যাকে বলে ‘গ্রেট ডাইং’ যুগ – যখন ৯৫ শতাংশ সামুদ্রিক প্রাণী এবং ৭০ শতাংশ স্থলচর প্রাণী মারা গিয়েছিল কিন্তু এত আকস্মিকভাবে নয়, অনেক দিন ধরে।

তবে ওই গ্রহাণুর আঘাতে বিশাল ডাইনোসর সহ পৃথিবীর তিন-চতুর্থাংশ প্রজাতির প্রাণীই নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল।

কিন্তু ছোট ছোট কিছু স্তন্যপায়ী প্রাণী মারা যায়নি – তারা ঠিকই বেঁচে ছিল।

পৃথিবীতে তখন কেমন প্রাণীরা বাস করতো?
ডাইনোসরদের যুগে পৃথিবীতে তারাই একমাত্র প্রাণী ছিল না। আরো বহু রকমের প্রাণী ও উদ্ভিদের বাসস্থান ছিল তখন এই পৃথিবী। সেই গ্রহাণুর আঘাতের পরও যারা মহাবিপর্যয়ে বিলুপ্ত হওয়া থেকে রেহাই পেয়েছিল তাদের মধ্যে ছিল একটি স্তন্যপায়ী প্রাণী ।

এর নাম পার্গাটোরিয়াস, দেখতে অনেকটা যেন একটা ছোট্ট কাঠবিড়ালি আর ছুঁচোর সংকরের মত। একে বলা হয় মানুষের জানা পৃথিবীর সবচেয়ে পুরোনো প্রাইমেট বা বানরজাতীয় প্রাণী।

গ্রহাণুর আঘাতের পর যেসব ডাইনোসর বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল তার মধ্যে ‘বিখ্যাত’ টিরোনোসরাস এবং ট্রাইসেরাটপ তো ছিলই – আরো ছিল নানা রকম প্রজাতি। কারো ছিল লম্বা গলা, কারো হাঁসের মত ঠোঁট, কারো গায়ে ছিল বর্মের মত চামড়া। এগুলো সবই ওই ঘটনার পর খুব দ্রুত মারা যায়।

এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক সারাহ শেলি বলছেন, সেই সময়টায় পৃথিবীতে অনেক রকম স্তন্যপায়ী প্রাণী ছিল – যারা ফল, বাদাম এবং নানা রকম বীজ খেয়ে বাঁচতো।

তা ছাড়া ছিল ডিডেলফোডন নামে এক ধরনের মাংসাশী প্রাণীও – যার আকৃতি ছিল মোটামুটি একটা বেড়ালের সমান।

কীভাবে বেঁচে গিয়েছিল এই পার্গাটোরিয়াস?
ক্রিটেসিয়াস যুগের এসব বড় বড় প্রাণীর পাশাপাশি ছিল ছোট আকারের স্তন্যপায়ী প্রাণী পার্গাটোরিয়াস – জীবজগতে তাদের স্থান ছিল খানিকটা এখনকার যুগের ইঁদুরের মতই । এরা এবং মানুষের পূর্বপুরুষরা কীভাবে সেই মহাদুর্যোগ থেকে বেঁচে গিয়েছিল সেটা এক বিরাট প্রশ্ন।

এ নিয়েই “দ্য রাইজ অ্যান্ড রেইন অব দ্য ম্যামলস” নামে একটি বই লিখেছেন এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টিভ ব্রুসেট। তিনি ও তার সহকর্মীরা এ নিয়েই গবেষণা করছেন। ব্রুসেট বলছেন, সেই দিনটি পৃথিবীর যত স্তন্যপায়ী, পাখী বা সরীসৃপ – সব প্রাণীর জন্যই ছিল একটা খুব খারাপ দিন।

“এর আগের ৫০ কোটি বছরের মধ্যে এত বড় গ্রহাণু পৃথিবীতে আঘাত করেনি, এবং তাতে স্তন্যপায়ীদের অবস্থাও প্রায় ডাইনোসরদের মতোই হতে যাচ্ছিল। “

গ্রহাণুর আঘাতের পর দাবানলে পৃথিবীর বনভূমি সব পুড়ে যায়। আকাশ ভরে গিয়েছিল ছাইয়ে। সূর্যের আলো পৃথিবীতে পৌঁছাতে পারছিল না এবং গাছের জন্য সালোকসংশ্লেষণ বা ফটোসিনথেসিস বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।

ব্রুসেট বলছেন, পৃথিবীর পুরো ইকোসিস্টেমটাই একটা তাসের ঘরের মত ভেঙে পড়েছিল। পৃথিবীর তাপমাত্রা প্রথমে বেড়ে গিয়েছিল – কিন্তু তার পর আবার ত্রিশ বছর ধরে ২০ডিগ্রি সেলসিয়াসেরও বেশি কমে গিয়েছিল।

এমন প্রতিকূল অবস্থায় টিকে থাকার জন্য স্তন্যপায়ী প্রাণীদের ক্ষুদ্র আকৃতি খুবই সহায়ক হয়েছে।

এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেকজন গবেষক অরনেলা বার্ট্রাণ্ড উদাহরণ দিয়ে বলছেন, যেমন আফ্রিকান হাতির মত বড় প্রাণীর বাচ্চা মায়ের পেটে থাকে ২২ মাস, আর ইঁদুরের গর্ভসঞ্চার থেকে বাচ্চা প্রসব পর্যন্ত সময় লাগে মাত্র ২০ দিন । সে কারণে ছোট আকারের প্রাণীর পক্ষে প্রতিকূল সময়ে দ্রুত বংশবৃদ্ধি করা সম্ভব।

“তা ছাড়া ছোট আকারের প্রাণীরা প্রজনন সক্ষমতাও অর্জন করে দ্রুত। কিন্তু একটা টি রেক্স ডাইনোসরের প্রজননের বয়সে পৌঁছাতে লাগে ২০ বছর।”

দ্বিতীয় সম্ভাব্য কারণ হচ্ছে মাটির নিচে বাস করা -বলছেন শেলি ।

তার কথায়, প্যালিওসিন যুগের এইসব ক্ষুদ্র স্তন্যপায়ী প্রাণী আধুনিক স্তন্যপায়ীদের মত নয়। তাদের আকৃতিও ছিল অদ্ভূত এবং তাদের সাথে মাটির নিচে গর্ত করে থাকা প্রাণীদের অনেক মিল পাওয়া যায়।

মাটির নিচে থাকার ফলে তারা গ্রহাণুর আঘাতে মাটির ওপর যে পরিবেশ তৈরি হয়েছিল তা অনেকটা এড়িয়ে থাকতে পেরেছে।

‘যা পাওয়া যায় তাই খাও’
গ্রহাণুর আঘাতের পর বেশির ভাগ জীবিত গাছপালাই ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল।

ফলে এই বিপর্যয়ের পর যেসব প্রাণীরা নির্দিষ্ট এক ধরনের খাদ্যের পরিবর্তে যা পাওয়া যায় তাই খাওয়া শুরু করেছিল – তারা টিকে থাকার ক্ষেত্রে অন্যদের চেয়ে এগিয়ে থাকতে পেরেছে।

শেলি বলছেন, “যেমন ডিডেলফোডন এমন কিছু প্রাণী শিকার করে খেতো তার সংখ্যা ছিল খুবই কম। অন্যদিকে ক্ষুদ্রাকৃতির প্রাণীর পক্ষে খাদ্য এবং জীবনধারায় পরিবর্তন আনা ছিল সহজ – এবং তা তাদের বিলুপ্তি ঠেকাতে সহায়ক হয়েছে। “

ব্রুসেট বলছেন, তবে যেসব প্রাণী বীজ খেতো – যেমন কিছু পাখী ও স্তন্যপায়ী প্রাণী – তাদের জন্য সেই বিপর্যয়ের পরও খাদ্যের অভাব হয়নি।

কিন্তু টি রেক্সের মত প্রাণীর পক্ষে ফলের বীজ খেয়ে বেঁচে থাকা সম্ভব ছিল না।

তিনি বলছেন, তা ছাড়া গ্রহাণুর আঘাতের পরেও এসব বীজ মাটিতে পড়ে টিকে ছিল। পরে যখন আবার সূর্যালোক পৃথিবীর বুকে পড়তে পারলো, তখন সেই বীজ থেকে আবার নতুন গাছ গজাতে শুরু করলো।

তা ছাড়া গ্রহাণুর আঘাতের পরেও এসব বীজ মাটিতে পড়ে টিকে ছিল। পরে যখন আবার সূর্যালোক পৃথিবীর বুকে পড়তে পারলো, তখন সেই বীজ থেকে আবার নতুন গাছ গজাতে শুরু করলো।

স্তন্যপায়ীদের সংখ্যা ও আকার বৃদ্ধি
প্যালিওসিন যুগের পর ধীরে ধীরে পৃথিবীর ইকোসিস্টেম আবার ক্ষতি কাটিয়ে উঠলো, এবং স্তন্যপায়ী প্রাণীরা ডাইনোসরের শূন্যস্থান পূরণ করতে শুরু করলো।

এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা দেখেছেন যে এ সময় স্তন্যপায়ীরা আকারে বড় হতে শুরু করে ।

এটাই ছিল সে সময়কার বিবর্তন বা অভিযোজনের ক্ষেত্রে প্রধান প্রবণতা।

এর একটি ছিল তৃণভোজী প্রাণী এক্টোকোনাস – মনে করা হয় যে এরা হয়তো বর্তমানকালের গরু-ঘোড়ার মত খুরওয়ালা প্রাণীর সাথে সম্পর্কিত। ডাইনোসর বিলুপ্তির কয়েক লক্ষ বছরের মধ্যেই এদের ওজন বেড়ে ১০০ কেজির মত হয়ে যায়। ভৌগলিক দিক থেকে এটা খুবই কম সময়।

শেলি বলছেন, সে সময়কার আরো কিছু প্রাণীর ক্ষেত্রে একই প্রবণতা দেখা যায়।

ব্রুসেট বলছেন, ডাইনোসরের মত এত বিশাল আকারের একটি প্রাণী – যারা লক্ষ লক্ষ বছর টিকে ছিল – তাদের এত অল্প সময়ের মধ্যে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়াটা খুবই চমকপ্রদ।

“তারা নতুন বাস্তবতার সাথে খুবই বেমানান ছিল এবং তারা খাপ খাইয়ে নিতে পারেনি।“

পৃথিবীতে গ্রহাণুর আঘাতের পুরো ব্যাপারটাই এত আচমকা ঘটেছে এবং তার ফলে এত বিরাট পরিবর্তন ঘটে গেছে যে গবেষকরা বলছেন, ব্যাপারটা তাদের মনে গভীর রেখাপাত করেছে।

“আমরা যে এই পৃথিবীতে আছি তা একান্তই ঘটনাচক্রে” – বলছেন বার্ট্রাণ্ড, “এমনও তো হতে পারতো যে গ্রহাণুটা পৃথিবীতে আঘাত করলো না, অথবা এটা পৃথিবীরই অন্য একটা প্রান্তে সাগরের মধ্যে গিয়ে পড়লো। কিন্তু তাহলে এর ফলে প্রাণীজগতে যে প্রাকৃতিক নির্বাচন ঘটতো – তা হতো একেবারেই অন্যরকম।“

“আমি যখন এ ব্যাপারটা ভাবি তখন আশ্চর্য হয়ে যাই“ -বলছেন তিনি।

তবে পৃথিবীতে আজ যে স্তন্যপায়ীরা বেঁচে আছে, তাদের দিক থেকে হয়তো যা হয়েছে – ভালোই হয়েছে। অন্য কিছু হলে হয়তো তারা থাকতো না।

এই সংক্রান্ত আরও খবর

এই পাঁচ প্রতিষ্ঠান কিনে আরও বেশি লাভবান গুগল

Shahadat Hossen

ক্রোম ব্রাউজার নিয়ে গুগলের নতুন ঘোষণা

Shahadat Hossen

ব্যবহারকারীর ঘুমের সময় জানাবে টিকটক

Shahadat Hossen

৫ মিনিটে তিন লাখ স্মার্টফোন বিক্রি

Shahadat Hossen

প্রতিদিন গড়ে ১০ হাজার গাড়ি বিক্রি, রেকর্ড ২০২২ সালে

Shahadat Hossen

নতুন বছরে হোয়াটসঅ্যাপে নতুন সুবিধা

Shahadat Hossen

Leave a Comment