দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হলেও মধ্যাঞ্চলে নদনদীতে পানি বাড়ছে। এতে গত ২৪ ঘণ্টায় মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, ফরিদপুর, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, টাঙ্গাইল, কিশোরগঞ্জ ও ঢাকা জেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা সতর্কীকরণ ও পূর্বাভাস কেন্দ্র জানিয়েছে, দেশে নদনদীর ১০১টি পর্যবেক্ষণ পয়েন্টের মধ্যে ৪৪টিতেই শুক্রবার পানি বেড়েছে। এর মধ্যে ২২টি পয়েন্টে নদীর পানি বিপত্সীমার ওপর দিয়ে বইছে। আর ৫৭টি পয়েন্টে পানি কমতে শুরু করেছে। ফলে সিলেট, সুনামগঞ্জ, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, বগুড়া, জামালপুর, নাটোর, নওগাঁ ও সিরাজগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। চলমান বন্যায় এখন পর্যন্ত দেশের ১৮ জেলার ৯২ উপজেলার ৫৩৫টি ইউনিয়ন দুর্গত হয়েছে। সরকারি হিসাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় ২২ লাখ মানুষ। এদিকে উত্তরাঞ্চলে বানভাসি মানুষ সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন। বন্যার্ত মানুষ তাদের বাড়িঘর ছেড়ে গবাদি পশু ও গৃহস্থালিসামগ্রী নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে ছুটছেন। খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি ও গোখাদ্যের চরম সংকট দেখা দিয়েছে। এছাড়া নদীভাঙনে বিলীন হচ্ছে একের পর এক গ্রাম, জনপদ ও গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। সরকারের পক্ষ থেকে বন্যার্তদের মধ্যে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করা হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল।
মুন্সীগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, পদ্মা ভাগ্যকূল পয়েন্টে বিপত্সীমার ৬২ এবং মাওয়ায় ৫৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি বইছে। ফলে জেলার নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। কয়েক হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। পানি বৃদ্ধির পাশাপাশি নদীভাঙন দেখা দিয়েছে। কামারখাড়া মুন্সীবাড়ী পয়েন্টে দুই সেতুর সংযোগ সড়কের একাংশ বিলীন হয়ে গেছে। এতে কামারখাড়া-আদাবাড়ী এবং দীঘিরপাড়-কামারখাড়া-ভাঙ্গুনিয়া সড়ক যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে।
পদ্মার তীব্র স্রোত আর ঘূর্ণাবর্তে শিমুলিয়া-কাঁঠালবাড়ী নৌরুটে ফেরি চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। বৃহস্পতিবার রাত ৮টায় পদ্মায় পানি বৃদ্ধির ফলে বয়া ডুবে যাওয়ায় দেশের গুরুত্বপূর্ণ এই নৌরুটে ফেরি চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। শুক্রবার একাধিকবার চেষ্টা করেও কোনো ফেরি চ্যানেলে ঢুকতে পারেনি। বিষয়টির সত্যতা নিশ্চিত করেছেন বিআইডব্লিউটিসির শিমুলিয়া ঘাটের এজিএম মো. শফিকুল ইসলাম। এদিকে দীর্ঘসময় ফেরি চলাচল বন্ধ থাকায় উভয় ঘাটে সৃষ্টি হয়েছে দীর্ঘ যানজট। গতকাল সন্ধ্যায় উভয় পাড়ে ১২ শতাধিক যান পারাপারের অপেক্ষায় ছিল।
মানিকগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, জেলায় বিপত্সীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হছে পদ্মা-যমুনা নদীর পানি। এতে প্লাবিত হচ্ছে নিম্নাঞ্চল। দৌলতপুর, শিবালয় ও হরিরামপুর উপজেলার কয়েক হাজার বাসিন্দা ভাঙন আতঙ্কে রয়েছেন। জেলা সদর, ঘিওর ও সাটুরিয়া উপজেলায় ফসলি জমিতে বন্যার পানি প্রবেশ করেছে। এতে আউশ, আমন, ভুট্টাসহ বিভিন্ন ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড মানিকগঞ্জ কার্যালয় সূত্র জানিয়েছে, শুক্রবার সকাল ৯টার দিকে শিবালয়ের আরিচা পয়েন্টে যমুনা নদীর পানি বিপত্সীমার ৭০ সেন্টিমিটার এবং হরিরামপুরে পদ্মার পানি ৬৮ সেন্টিমিটার ওপর প্রবাহিত হচ্ছিল। জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, বন্যায় এ পর্যন্ত ৭৪ বর্গকিলোমিটার এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এতে জেলার ৭ হাজার ৩০৬ হেক্টর জমির ফসলের ক্ষতি হয়েছে।
সদরপুর (ফরিদপুর) সংবাদদাতা জানান, উপজেলায় পদ্মা ও আড়িয়াল খাঁ নদে পানি বৃদ্ধির ফলে উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়ন আবার নতুন করে বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে। কয়েক হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
চরভদ্রাসন (ফরিদপুর) সংবাদদাতা জানান, উপজেলায় গত কয়েক দিনে পদ্মা নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হওয়ার পাশাপাশি বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। সেই সঙ্গে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে প্রায় সাড়ে ৮ হাজার পরিবারের মানুষ। চরাঞ্চলে স্যানিটেশন, গোখাদ্য সংকট ও বিশুদ্ধ খাবার পানির সমস্যা দেখা দিয়েছে। অনেকেই আশ্রয়কেন্দ্রের উঁচু স্থানে গরু-ছাগল নিয়ে উঠেছেন।
মির্জাপুর (টাঙ্গাইল) সংবাদদাতা জানান, বংশাই-লৌহজং নদীর পানি বাড়তে থাকায় উপজেলায় বহু ঘরবাড়ি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাটবাজার, ফসলি জমি এবং রাস্তাঘাট ডুবে গেছে। অসহায় পরিবারগুলো গবাদি পশু নিয়ে দুর্বিষহ জীবনযাপন করছেন।
মেলান্দহ (জামালপুর) সংবাদদাতা জানান, উপজেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। উপজেলা সদরের সঙ্গে ১১টি ইউনিয়নের সরাসরি সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। পানিবন্দি মানুষ খাদ্য ও পানীয় সংকটে পড়েছে।
নিকলী (কিশোরগঞ্জ) সংবাদদাতা জানান, উপজেলার সিংপুর ইউনিয়নের কাশিপুর গ্রামে বন্যার পানিতে ২ শতাধিক পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন।
ন?ওগাঁ প্রতিনিধি জানান, জেলায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের কয়েকটি জায়গা ভেঙে রানীনগর, আত্রাই ও মান্দা উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়ে প্রায় ৪ হাজার হেক্টর জমির ফসলের ক্ষতি হয়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন প্রায় লক্ষাধিক মানুষ। বন্যাকবলিত পরিবারের শত শত লোকজন আসবাবপত্র নিয়ে বাঁধ ও উঁচু স্থানে অবস্থান নিয়েছেন। বিশুদ্ধ পানি ও খাবার সংকট দেখা দিয়েছে।
আত্রাই (নওগাঁ) সংবাদদাতা জানান, আত্রাই নদীর পানি কিছুটা কমলেও উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। তিন স্থানে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভাঙার ফলে বিভিন্ন গ্রামে পানি প্রবেশ করেছে। আত্রাই নদীর পানি এখনো বিপত্সীমার প্রায় ৫০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। উপজেলার প্রায় লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। এদিকে বাঁধ ভেঙে যাবার ফলে আত্রাই-সিংড়া এবং আত্রাই-বান্দাইখাড়া সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে।
সিলেট অফিস জানায়, সিলেট ও সুনামগঞ্জের নদীর পানি কিছুটা কমলেও বানভাসি মানুষের দুর্ভোগ কমেনি। শুক্রবার বিকালের মুষলধারার বৃষ্টি বন্যাকবালিত ১৭ উপজেলার প্রায় ৩ লাখ মানুষকে আবার দুশ্চিন্তায় ফেলেছে। সুনামগঞ্জে সুরমা নদীর পানি বৃহস্পতিবার শহরের কাছে বিপত্সীমার নিচে নেমে এসেছে। কিন্তু অনেকের ঘর থেকে পানি নামেনি। সিলেটের গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ ও সিলেট সদরের সড়ক যোগাযোগ বিভিন্ন স্থানে ব্যাহত হচ্ছে। সুনামগঞ্জের তাহিরপুর, বিশ্বম্ভরপুর, দোয়ারাবাজার, ছাতক ও জামালগঞ্জ উপজেলার সঙ্গে জেলা শহরের সড়ক যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। বিশুদ্ধ পানীয় জলসহ মানুষ ও গবাদিপশুর খাদ্য সংকটে বানভাসিরা পড়েছেন বিপাকে।
কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি জানান, জেলায় ব্রহ্মপুত্র ও ধরলার পানি সামান্য কমলেও এখনো বিপত্সীমার অনেক ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। জেলার ৯ উপজেলার ব্রহ্মপুত্র ও ধরলা অববাহিকার প্রায় আড়াই শতাধিক চরাঞ্চলের ২ লাখ মানুষ মানবেতর জীবন যাপন করছে। এসব মানুষের মধ্যে বিশুদ্ধ খাবার পানি ও শুকনো খাবারের সংকট তীব্র হয়ে উঠছে।
সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় যমুনা নদীর পানি ৫ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপত্সীমার ৯৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এতে নদী অববাহিকার নিম্নাঞ্চল ও চরাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এতে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে পাট, ভুট্টা, শাকসবজিসহ বিভিন্ন ফসল।
সারিয়াকান্দি (বগুড়া) সংবাদদাতা জানান, শুক্রবার সারিয়াকান্দি পয়েন্টে যমুনার পানি বিপত্সীমার ১২৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় চরাঞ্চল ও নদী তীরবর্তী এলাকার মানুষ সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন।